তিনটি দীর্ঘ কবিতা | সরদার মোহম্মদ রাজ্জাক
তিনটি দীর্ঘ কবিতা | সরদার মোহম্মদ রাজ্জাক

নিরাহার

(এই কবিতাটি একটি আসন্ন দুর্ভিক্ষের ওপর রচিত)

 

'আমি পথ হাঁটিতেছি'--

হাঁটিতেছি দিন রাত্রির আলো আর আঁধার-অরণ্যের গহীন গাঙে

গহীন গাঙের কুমারী নির্ঝরিনির শব্দ-শূন্য তটের কিনারে দাঁড়িয়ে

আমার অপেক্ষায় প্রিয়লতা;

রাত্রিরা কখন ঘুমায়?

হাজার হাজার রাত্রি কী অদ্ভুত ঘুমিয়েছে কি পথের ধুলোয়

গাঢ় হলুদ আঁধারের রাশি রাশি রঙ্গিন সূতো অসভ্যের মতো

বেধে রেখেছে আমার হৃদয়--

তবুও হাঁটিতেছি আমি নিস্তব্ধ নিস্তরঙ্গ হয়ে--

অথচ কি দ্যাখো--

অফিস পাড়ায় দারুণ হা-হাকার ধ্বণি--আকাশটি কাঁপছে বুঝি!

ভিক্ষে চাইতে এসেছে সব ছিন্নবস্ত্র উদোম শরীর--

রাষ্ট্রের সম্ভ্রান্ত নাগরিক-

চৌর্যবৃত্তিতে পারদর্শী অমায়িক বেড়ালটিও হাসছে কেমন!!

বড়বাবু ছোটোবাবু আর মর্যাদার পালক লাগানো কুলশীল

নাগরিকদের কাণ্ড দেখে-

বুঝি মূর্ছাই যাবে বেড়ালটি!!

আহা! বড় আদরীনি বেড়াল--কাণ্ড দেখে ভারী কষ্ট ওর!!

ওদেরই ভিক্ষের দানাই চুরি করে যে-

উদর পুর্তি করবে বেড়ালটি-

ওকেও তো বাঁচতে হবে এই দুর্ভিক্ষ পাড়ি দিয়ে।

এক নিঃসঙ্গ দীন হীন হাভাতে রাষ্ট্রের মালিক

কাছে এসে বলে--"ভিক্ষের চাল হবে তোমার কাছে?

আহ্ কতদিন চালের গন্ধে মাতাল হইনি আমি--

ভগবান বুদ্ধের কাছে চেয়েছিলাম কিন্তু পাই নি-

ভগবান বুদ্ধের কর্ণে পশে নি আমার প্রার্থণা--

দাও না দু মুষ্ঠি ভিক্ষের চাল--

পোনাগুলি বাঁচবে অন্ততঃ

একটি বেলার জন্যে হলেও-

দেবে না??"

আবার হাটিতেছি আমি--দূর দূর বহুদূর--

কুমারী নির্ঝরিনির কিনারে অপেক্ষমান

প্রিয়লতার কাছে নয় আর--

আমাকে ক্ষমা করো প্রিয়লতা

মানুষ বাঁচাতে হবে--

যদি পারো কাছে এসো আমার

আমার হাতের ওপর হাত রেখে-

চলো আমরা নবতর যাত্রা শুরু করি

মানুষ বাঁচাবার-----

এবারের দিকচিহ্নহীন যাত্রা আমার

গোলাভরা ধান আর চালের সন্ধানে--

উত্তরের হাওয়া বিপরীতে

দক্ষিণের জানালা খুলবার

প্রমিথিউসের আগুন হাতে নিয়ে।

 

 সিদ্ধ পুরুষ

(কবিতাটি সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে)।

 

দীর্ঘ প্রলম্বিত অলক সম্ভার

ভারী নিতম্ব অতিক্রমী;

উন্মুক্ত পৃষ্ঠদেশ অন্তর্বাস বিহীন

কেবল স্ফীত বক্ষ দু'টি আবৃত

শাড়ীর আঁচলের প্রান্তভাগ দিয়ে--

হেঁটে যাচ্ছে একটি তরুণী।

পেছনে অলুব্ধ শ্রীহীন তরুণ

যাবর কাটছে দুর্বোধ্য কবিতার

তরুণীর শ্রবন পর্যন্ত পৌঁছোয় না সে কবিতার

ছন্নছাড়া মর্মবাণী--

দূরত্ব অনেকটাই।

আমার প্যন্টের দু'পকেট ভর্তি

উচ্ছিষ্ট বাতাসের ক্রন্দন-নদী

তরঙ্গ আশ্রিত হয়েছে আমার বুকে কখন জানি

ঢেউ নেই সে নদীর জলে--

সব ঢেউ যেনো তরুণীটির চলার ভঙ্গিমায়।

নিপুণ বটবৃক্ষের নিচে এক বৃদ্ধ সুফী সাধক

কী আর কিসের সাধনা করছে

নিজেই জানেনা হয়তো!!

একমুঠো রোদের প্র্ত্যাশা আমার অনেক দিনের

বরফের কুচি শুধু সান্তণা দেয়-

আবার আসবে রৌদ্রের আগুন

আবার বসবে রৌদ্রের হাট-- যত খুশি নিও তুমি

তোমার মুঠো দু'টি পূর্ণ করে।

আমি প্রার্থণা করি--হে অনন্ত অসীম শূন্যতা--

জড়িয়ে রেখো আমার করতল দু'হাতের

যেনো আমি রৌদ্রের উত্তাপ স্পর্শকে অনুভব করতে পারি;

পূণর্বার প্রার্থণা করি আমি--

হে অনন্ত অসীম শূন্যতা আমার শ্রবনে ঢেলে দাও তুমি

একটি সামান্য পতঙ্গ ঝি ঝি পোকার অবিমিশ্র অন্তহীন

সঙ্গীতের প্রাণান্ত বান--আমার কর্ণকে বিদীর্ণ করুক--

অসহ্য অনঙ্গ কন্যার বিস্রস্ত আহ্বান ভালো লাগে না আমার।

তরুণী জানু পেতে প্রনামে ব্যস্ত হয়;

বৃদ্ধ সুফীর পদ যুগলের নিচে-

ক্রোধিত হয় বৃদ্ধ সুফী--বিলম্ব হয়েছে অনেক প্রহর

নির্দেশ তো এমন ছিলো না।

এরপর সেই বৃদ্ধ সুফীর জানালা-শূন্য কক্ষে--

প্রবেশের অধিকার প্রাপ্ত হয় তরুণীটি।

এখনও সেই শ্রীহীন তরুনটি কবিতারই যাবর কাটতে থাকে

দেখেও না দেখার ধ্যানে মগ্ন তরুন-

প্রতিবাদ করেনা মোটেই;

আকাঙ্ক্ষা-- বৃদ্ধ সুফীর উচ্ছিষ্ট পাবার।

তোলপাড় তোলে বূদ্ধ সাধক সুফী

তরুণীটির উলঙ্গ অঙ্গ প্রত্যঙ্গে,

বিদ্ধস্ত হয় দু'জনই--

এ যেনো সেই আনন্দের 'সম্দ্রু সফেন'।

বেরিয়ে আসে তরুণীটি দু'চোখে শ্রাবনের ধারা নিয়ে।

এবার তরুনটি মেয়েটির কাছে যায়,

তাকায় মেয়েটির মুখের দিকে--

ক্রোধ আর ঘৃণায় থুথু দেয় তরুণীটি

তরুনটি মুখে।

বেরিয়ে আসে সাধক সুফী

তরুনটি স্থান নেয় সুফীর দৃষ্টিত।

চিৎকার করে ওঠে বৃদ্ধ সুফী--

'ধ্বর্ম পালন করো।'

"এক কানা কয় আর এক কানারে চলো এবার ভব পারে

নিজে কানা পথ চেনে না পরকে বলে বারংবার।"

এই চরণ দু'টিতেই মৃত্যু হলো সুফী সাধকের --

ভণ্ড আর ভণ্ডই শুধু রয়ে গেলো।

আমি আমার সব শূন্যতাকে

পকেট মুক্ত করে বাতাসের ক্রন্দন-নদীকে

আবার মিলিয়ে দিই বাতাসের মুক্ত ডানায়।

 

 

ফরমালিন

 

 

অবশিষ্ট রাতের বর্ণহীন নিরাকার জল

কখন যেনো আমার ছায়া হয়ে যায় কে জানে??

শীতল অরণ্যাংশের কোনো একটি শাখায়

আমি নিদ্রিত হয়েছি

বিবর্ণ বাতাসের সাথে হলোনা বাসর

কুলভাঙ্গা রজনীর প্রলাপ বিলাপে;

আমি শুধু দেখি--

দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে যাই--

প্রার্থণা করি পৃথিবীর কাছে একটি ভীষণ যুদ্ধের;

জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে যে মেয়েটি--

ওর নাম ময়ুরাক্ষি;

ও-ও যুদ্ধ চায়--ময়ুরের সাহসী যুদ্ধ

পেখমগুলি ওর হবে তখন--

আহ্লাদে আটখানা হয়--তাকায় আমার দিকে মিট মিট করে--

আর বলে-- এনে দেবে আমাকে সবক'টি ময়ুর-পেখম??

আশ্চর্য প্রশ্ন করে আমাকে,

আবার বলে এনে দাওনা আমাকে একটি-

ওই যে সবুজ ফরিঙ

মুসুরের ডগাগুলি কেমন চিবিয়েই যাচ্ছে দ্যাখো?

আমার ভীষণ কষ্ট হয়--মায়া হয়,

ফরিঙটিকে খুন করতে চাই আমি।

আমি তখন গন্ধর্বের নাভিমূলের চারপাশে--

কেবলই গোলাপী মাংসের নেশা দেখতে থাকি;

পাগলই হয়ে যাবো বুঝি!!

প্রদোষের প্রপঞ্চ আমার যেনো 'ধৃতরাষ্টের'- মতো--

কেবলই ভ্রমের আশ্রয়ে সমর্পিত হয়ে যায়।

হঠাৎ একটি লম্পট চড়ুই কোথা থেকে উড়ে এসে

অবগাহন করতে চায় ফিঙের জলধিতে--

তুমুল যুদ্ধ হয় দু'জনে-

ফিঙেটি হেরে গিয়ে কেবলই ডানা ঝাপটায়-

চড়ুইটি ফিঙের উপরে পুচ্ছ নাচায়।

কিম আশ্চর্যম!!

এখানেও ফরমালিন; সবই বিষাক্ত আর ঊল্টোরথ।

ইচ্ছে করেই ময়ুরাক্ষি কাছে আসে আমার-

নিদ্রা থেকে জোর করে জাগিয়ে

চুম্বনে চুম্বনে রক্তাক্ত করে দেয় আমার দু'টি

ঠোঁটের প্রাণ;

বড্ড তিতেটে চুম্বন--

বুঝি আমি-- চুম্বনেও ফরমালিন।

ফরমালিন নেই কোথায়!!

আসমুদ্র হিমাচল মন্থন করে

আমি যে অমৃত ভাণ্ড পূর্ণ করে এনেছি

সবুজ অরণ্য বিদ্ধস্ত করে দিয়ে--

মৃত্যুঞ্জয়ী হবার আকাঙ্ক্ষায়

যে নির্যাস আমি তুলে এনেছি

তা-ও হলুদ হয়ে গেছে--এখানেও ফরমালিন;

চক্রবাকের রাশি রাশি সুবোধ কৌটিল্য দিয়ে

আমি যে গৃহ নির্মাণ করেছি-

সে গৃহের প্রতি কোণে কে বা কারা ছড়িয়ে দিয়েছে

ফরমালিন;

ফরমলিনের উৎকট সুবাসে-

অবশিষ্ট রাতের বর্ণহীন নিরাকার জল

কখন যে আমার ছায়া হয়ে গেছে কে জানে??

এখন আমি নিজেই যেনো--

আশির্বাদী ফরমালিন।।

 


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান